2.1 স্থিতি ও গতি

ভূমিকা:

ইংরেজিতে "motion" কথাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ "movere" বা "motio" থেকে, যার অর্থ "to move" অর্থাৎ স্থান পরিবর্তন করা। 

বিজ্ঞানের যে শাখায় বস্তুর গতি সম্পর্কে এবং গতিশীল বা স্থির বস্তুর উপর বলের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয় সেই শাখাকে বলবিজ্ঞান (mechanics) বলা হয়।


বলবিজ্ঞানকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয় - 1) গতিবিজ্ঞান (Dynamics) এবং 2) স্থিতিবিজ্ঞান (Statics)।

1) গতিবিজ্ঞান: এই শাখায় বস্তুর গতি সম্বন্ধে এবং গতিশীল বস্তুর উপর বলের প্রভাব সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়। এটি আবার দুটি অংশে বিভক্ত।

A) সৃতিবিজ্ঞান (Kinematics): এই অংশে বস্তুর গতি বর্ণনা করা হয়, গতির কারণ অনুসন্ধান করা হয় না।

B) চলবিজ্ঞান (Kinetics): এই অংশে গতির কারণ অনুসন্ধানসহ গতির আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়। এক্ষেত্রে বস্তুর ভর এবং তার ওপর প্রযুক্ত বলের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়।

2) স্থিতিবিজ্ঞান: বিভিন্ন বলের ক্রিয়ায় কোনো বস্তুর সাম্যাবস্থা (equilibrium) ও তার শর্তাবলি এই শাখায় আলোচনা করা হয়।

স্থিতি ও গতি (Rest & Motion):

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সেগুলোর মধ্যে কোনটি স্থির এবং কোনটি গতিশীল সেটি চোখে দেখেই বুঝতে পারি। যেমন গাছপালা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটকে আমরা স্থির দেখি। আবার যানবাহন চলাচল করে, পাখিরা আকাশে ওড়ে, বাতাস বইলে গাছ নড়ে, এমনকি আমাদের শরীরের মধ্যেও অবিরাম রক্ত বয়ে চলেছে। 

স্থিতি: সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনো বস্তু পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে অবস্থান (position) পরিবর্তন না করে, তবে তাকে স্থির বস্তু বা স্থিতিশীল বস্তু বলা হয় এবং তার অবস্থাকে স্থিতি বলা হয়। 

গতি: সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি কোনো বস্তু পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে অবস্থান (position) পরিবর্তন করে, তবে তাকে গতিশীল বস্তু বলা হয়।

চরম স্থিতি (absolute rest) ও চরম গতি (absolute motion): আসলে আমরা বস্তুর স্থিতি বা গতি বিচার করি পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে। সাধারণত আমরা ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে দেখি কোনো বস্তু স্থির না গতিশীল। তাই ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন গাছপালা, বাড়িঘরকেও স্থির মনে হয়। কিন্তু তোমরা জানো পৃথিবী নিজেই স্থির নয়। নিজের অক্ষের সাপেক্ষে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের চারিদিকে অবিরাম ঘুরে চলেছে। আবার সূর্যও স্থির নয়। আমাদের galaxy তে অন্যান্য নক্ষত্রের সাপেক্ষে সূর্যও গতিশীল। আবার galaxy গুলোও পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির নয়। সুতরাং, এই মহাবিশ্বে এক্কেবারে স্থির বস্তু নেই অর্থাৎ চরম স্থিতি বলে কিছুই নেই।

আমরা স্থির বস্তুর সাপেক্ষে কোনো বস্তুর গতি বুঝতে পারি। সুতরাং, এই মহাবিশ্বে এক্কেবারে স্থির কোনো বস্তু খুঁজে পেলে তার সাপেক্ষে কোনো বস্তুর গতি হবে চরম গতি। অর্থাৎ ওই এক্কেবারে স্থির বস্তুর ওপর থাকা কোনো দর্শকের চোখে অন্য কোনো বস্তুর গতিকে তার চরম গতি বলা যায়। কিন্তু, আগেই আলোচনা করলাম এই মহাবিশ্বে এক্কেবারে স্থির কোনো বস্তু জানা নেই। তাই চরম গতি বলেও কিছু নেই।
 

নির্দেশতন্ত্র (Reference Frame):

আগেই বললাম আমরা বস্তুর স্থিতি বা গতি বিচার করি অন্য কোনো একটি বস্তু বা পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে। এই অন্য বস্তু বা বস্তুসামগ্রীকে নির্দেশতন্ত্র বলা হয়। যেমন ধরো, সূর্যকে স্থির ধরে নিয়ে পৃথিবীর গতি বিচার করি। এখানে সূর্য হলো নির্দেশতন্ত্র। আবার কোনো গাড়ির গতি বিচার করলে আমরা পৃথিবীকে স্থির ধরি। এখানে পৃথিবী হলো নির্দেশতন্ত্র।

যেহেতু চরম স্থিতি বা চরম গতি বলে কিছুই নেই তাই আমরা বলতে পারি, বস্তুর গতি হলো আপেক্ষিক (relative)। এই বিষয়টি একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝা যাক। ধরো, তুমি আর তোমার বন্ধু ট্রেনে মুখোমুখি বসে আছো। তোমার সাপেক্ষে তোমার বন্ধু স্থির, তাই তো? কিন্তু ট্রেনের বাইরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মানুষ দেখবে তোমরা দুজনেই গতিশীল। তোমার বা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দুজনের কথাই তো সত্যি! আবার ধরো, তোমার ট্রেনের পাশে আর একটি ট্রেন একই গতিবেগে, একই দিকে যাচ্ছে। তাহলে ওই ট্রেনের মধ্যে বসে থাকা কোনো যাত্রীকে তোমার স্থির বলে মনে হবে। যদিও তোমরা দুজনেই ভূমির সাপেক্ষে গতিশীল।

কার্টেজীয় নির্দেশতন্ত্র (Cartesian frame of reference): 

ফরাসি গণিতজ্ঞ দেকার্ত (Descartes) এর উদ্ভাবন করেন।

একমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র: ধরো, তোমার বাড়িতে কোনো অতিথি এসেছে। তুমি যেখানে থাকো সেখানকার সবকিছু সে চেনে না। তোমার বাড়ির সবথেকে কাছে কোথায় দোকান আছে সে জানতে চাইলো। তুমি বললে তোমার বাড়ি থেকে 100 m দূরে একটা দোকান আছে। শুধু এটুকু বললেই কি সে দোকানটার অবস্থান বুঝতে পারবে? অবশ্যই না। তোমাকে দিকটাও উল্লেখ করে বলতে হবে, তোমার বাড়ি থেকে পূর্বদিকে 100 m দূরে সোজা চলে গেলে দোকানটা দেখতে পাবে। দেখো এই ঘটনাটাকে আমরা এখন এভাবে লিখবো। ধরো, "A" হলো তোমার বাড়ির অবস্থান। "B" হলো তোমার বাড়ি থেকে পূর্বদিকে 100 m দূরে অবস্থিত দোকান। এটি একটি একমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র যার মূলবিন্দু হলো "A"। 

গতি সংক্রান্ত আলোচনা সময়ে অনেক ক্ষেত্রে বস্তুর আকার ও আয়তন উপেক্ষা করে তাকে একটি জ্যামিতিক বিন্দু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই জ্যামিতিক বিন্দুকে বস্তুকণা (particle) বলা হয়। ধরো, একটি কণা একমাত্রিক দেশে X - অক্ষ বরাবর গতিশীল, একটি নির্দিষ্ট বিন্দু O হলো মূলবিন্দু এবং কোনো এক মুহুর্তে কণাটির অবস্থান হল P বিন্দু। O বিন্দু থেকে কণার দূরত্ব x - সাহায্যে কোনটির অবস্থান নির্দেশ করা যায়। অর্থাৎ O থেকে ওই কণাটির দূরত্বের সাহায্যেই কণাটির অবস্থান সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব। এরূপ ক্ষেত্রে কণার গতিকে একমাত্রিক গতি এবং X-অক্ষকে একমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র বলা হয়।

দ্বিমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র: কোন কণা যদি একটি দ্বিমাত্রিক স্থানে অর্থাৎ একটি সমতলে অবস্থান করে তবে তার অবস্থান সূচিত করার জন্য দুটি পরস্পর লম্ব অক্ষ OX ও OY নিতে হয়। এক্ষেত্রে (x,y) স্থানাঙ্ক দ্বারা কণাটির অবস্থান (P) সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব। X এবং Y অক্ষ দিয়ে গঠিত নির্দেশতন্ত্রকে দ্বিমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র বলা হয়। 

O থেকে P এর দূরত্ব, 
r = OP = `sqrt{OA^2+AP^2}`
`= sqrt{x^2+y^2}`

ত্রিমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র: কোন কণা যদি ত্রিমাত্রিক স্থানে অবস্থান করে তবে তার অবস্থান সূচিত করার জন্য তিনটি পরস্পর লম্ব অক্ষ OX, OY ও OZ নিতে হয়। এক্ষেত্রে (x,y,z) স্থানাঙ্ক দ্বারা কণাটির অবস্থান (P) সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব। এরকম নির্দেশতন্ত্রকে ত্রিমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র বলা হয়। 

O থেকে P এর দূরত্ব, r = OP = `sqrt{x^2+y^2+z^2}`

এটা মাথায় রাখবে, আমরা নির্দেশ ফ্রেম কখন কেমন কীভাবে নেবো সবটাই নিজের ইচ্ছা। একটি বস্তু যদি সরলরেখা বরাবর গতিশীল হয়। তাহলে আমরা যে কোনো নির্দেশতন্ত্রই নিতে পারি। আবার এমনও নয় যে , X অক্ষ বরাবরই তার গতি বিশ্লেষণ করতে হবে। যে কোনো অক্ষ বা যে কোনো দিকে তার গতি বিচার করতে পারি।

B) পোলার নির্দেশতন্ত্র (Polar frame of reference): 

এটি একটি দ্বিমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র। O মূলবিন্দু। এটিকে মেরু (pole) বলা হয় এবং OX রেখাকে মেরু অক্ষ (polar axis) বলা হয়। OP সরলরেখার দৈর্ঘ্য r এবং এটি OX এর সাথে `\theta` কোণ উৎপন্ন করে। এই নির্দেশতন্ত্রে `(r,\theta)` দ্বারা P বিন্দুর অবস্থান সূচিত করা হয়।
যদি কার্টেজীয় নির্দেশতন্ত্রে P বিন্দুর স্থানাঙ্ক (x,y) হয় তবে,
`x = rcos\theta` এবং `y = rsin\theta`

`x^2+y^2=r^2(cos^{2}\theta+sin^{2}\theta)`

বা, `r = sqrt{x^2+y^2}` এবং `tan\theta=\frac{y}{x}`

এটি হলো কার্টেজীয় এবং পোলার নির্দেশতন্ত্রে কোনো বিন্দুর স্থানাংকের মধ্যে সম্পর্ক।

C) গোলীয় নির্দেশতন্ত্র (Spherical frame of reference):

এটি একটি ত্রিমাত্রিক নির্দেশতন্ত্র। P বিন্দু থেকে `PP'` লম্ব টানা হলো। ধরো, মূলবিন্দু O থেকে P বিন্দুর দূরত্ব OP = r। OP রেখা OZ অক্ষের সাথে `\theta` কোণ এবং `OP'` রেখা OX অক্ষের সাথে `\phi` কোণ উৎপন্ন করে। এই নির্দেশতন্ত্রে P বিন্দুর স্থানাঙ্ক `(r,\theta,\phi)` দ্বারা নির্দেশিত করা হয়। তোমরা এই নির্দেশতন্ত্র নিয়ে পরে বিস্তৃত পড়াশোনা করবে।

গতির প্রকারভেদ: 

আমরা চারপাশে অনেক রকম গতি দেখতে পাই। 

সরলরৈখিক গতি (Rectilinear motion): 
কোনো গতিশীল বস্তু যদি সরলরেখায় চলে তাহলে তার গতিটি হচ্ছে সরলরৈখিক গতি। সোজা পথে চলা গাড়ির গতি বা ছাদ থেকে একটা বলকে ছেড়ে দিলে সেটি সোজা সরলরৈখিক পথে নীচে পড়ে।

চলন গতি (Translation Motion): 
কোনো কিছু যদি এমনভাবে চলতে থাকে যেন বস্তুর সকল কণা একই সময় একই দিকে যেতে থাকে তাহলে সেটা হলো চলন গতি।

বৈশিষ্ট্য: 
a) কোনো বস্তুর চলন হলে তার কণার গতিপথগুলি পরস্পরের সঙ্গে সমান ও সমান্তরাল হয়। 
b) চলনের ক্ষেত্রে বস্তুর মধ্যস্থ যেকোনো দুটি কণার সংযোজী সরলরেখা বস্তুটির বিভিন্ন অবস্থানে পরস্পরের সঙ্গে সমান্তরাল থাকে। চলন গতি সোজা হতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বস্তুর বক্ররেখা বরাবর চলনকে বক্র চলন বলা হয়।

ঘূর্ণন গতি (Rotational motion): 
কোনো বস্তু যদি একটি নির্দিষ্ট বিন্দু বা অক্ষের চারদিকে বৃত্তাকার পথে গতিশীল হয়, তবে তার গতিকে ঘূর্ণন বলা হয় এবং ওই অক্ষটিকে বলা হয় ঘূর্ণাক্ষ (axis of rotation)। ফ্যান, ঘড়ির কাঁটা ইত্যাদির গতি হলো ঘূর্ণন গতি। ঘূর্ণন অক্ষটি বস্তুর ভিতর দিয়ে যায়, যেমন ফ্যানের গতি। আবার ঘূর্ণন অক্ষটি বস্তুর বাইরেও থাকে। যেমন চাঁদ পৃথিবীর সাপেক্ষে তার চারদিকে ঘুরতে থাকে। এক্ষেত্রে ঘূর্ণন অক্ষটি বস্তুর বাইরে অবস্থিত।

বৈশিষ্ট্য:
a) কোনো বস্তুর ঘূর্ণন হলে তার প্রতিটি কণা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের অবকাশে একই কোণে ঘোরে।
b) ঘূর্ণন অক্ষটি সর্বদা স্থির থাকে।

মিশ্র গতি: 
কোনো বস্তুর যদি চলন ও ঘূর্ণন একসাথেই হয় তবে তাকে মিশ্র গতি বলা হয়। যেমন একটি চাকার গতি। চাকাটি তার নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়।

পর্যায়বৃত্ত গতি (Periodic motion): 
কোনো গতিশীল বস্তু যদি নির্দিষ্ট সময় পরপর একটি নির্দিষ্ট বিন্দু দিয়ে একই দিকে একইভাবে অতিক্রম করে তাহলে সেটাকে পর্যাবৃত্ত গতি বলা যায়। যেমন আমাদের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, ফ্যানের পাখা, স্প্রিং-এ ঝুলিয়ে রাখা দুলতে থাকা বস্তু ইত্যাদি। এই বিষয়ে পরে বিস্তারিত জানবে। ঘূর্ণন গতি একটি বিশেষ ধরনের পর্যায়বৃত্ত গতি। 

সরল দোলগতি (Simple Harmonic Motion): 
একটি বিশেষ ধরনের পর্যায়বৃত্ত গতি হচ্ছে সরল দোলগতি। একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর দুইপাশে বস্তুটি স্পন্দিত হয়। বস্তুটি একেবারে স্থিরাবস্থা থেকে ধীরে ধীরে গতিশীল হয়। কেন্দ্রবিন্দুতে সর্বোচ্চ গতিশীল হওয়ার পর এর গতি আবার কমতে থাকে। এক সময় স্থির হয়ে আবার বিপরীতদিকে গতিশীল হয়। এই গতির উদাহরণ হলো ঘড়ির পেন্ডুলাম। 

Leave a Reply:

Previous Post Next Post