
পরিমাপের ত্রুটি (Errors):
আমরা যখন কোনো ভৌত রাশির পরিমাপ করি, তখন তার প্রকৃত মান (true value) কখনোই বের করতে পারিনা। সেই মান কোনো না কোনো ভাবে প্রকৃত মান থেকে বেশি বা কম হয়। কোনো ভৌত রাশিকে পরিমাপ করলে, যতটুকু মান, প্রকৃত মান থেকে কম বা বেশি হয়, সেটিকে ওই ভৌত রাশি পরিমাপের ত্রুটি (error) বলে। এই ত্রুটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। পরিমাপ যন্ত্রের কারণে, পরিবেশের কারণে বা যিনি পরিমাপ করছেন তার নিজস্ব পাঠ নেওয়ার পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকলেও পরিমাপে ত্রুটি হয়।
পরিমাপের ত্রুটি সাধারণত দুই ধরনের হয় -
1) পদ্ধতিগত ত্রুটি (systematic error) এবং 2) অবিন্যস্ত ত্রুটি (random error)।
1) পদ্ধতিগত ত্রুটি: এই ত্রুটির কারণ আমরা জানি। অর্থাৎ কী কারণে ত্রুটি এসেছে সেটা আমরা বুঝতে পারি। পরিমাপের সংখ্যা যত বেশি হয়, ত্রুটির পরিমাণও তত কমে। এটি আবার দু ধরনের হয়:
(i) যান্ত্রিক ত্রুটি (Instrumental error): ত্রুটিপূর্ণ গঠন বা অংশাঙ্কন (calibration) যুক্ত কোনো যন্ত্রের সাহায্যে নেওয়া পাঠের ত্রুটি হল যান্ত্রিক ত্রুটি। যেমন, আমরা পরীক্ষাগারে স্লাইড ক্যালিপার্স ব্যবহার করে থাকি। স্লাইড ক্যালিপার্সের মূল স্কেলের 0 দাগ যদি ভার্নিয়ার স্কেলের 0 দাগের সাথে মিলে না যায় তাহলে ধরে নিতে হবে এই যন্ত্রে যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে।
(ii) ব্যক্তিনির্ভর ত্রুটি (Personal error): এই ধরনের ত্রুটি হয় অসতর্কভাবে পাঠ নেওয়া বা ভুল গণনা ইত্যাদির ফলে। যেমন দোলকের দোলনকাল নির্ণয়ের সময় যদি দোলন সংখ্যা নির্ণয় করতে ভুল হয় তাহলে সঠিক দোলনকাল পাওয়া যাবে না।
2) অবিন্যস্ত ত্রুটি: বিভিন্ন ধরনের জানা বা অজানা কারণে এলোমেলোভাবে এ ধরনের ত্রুটি ঘটে থাকে। যেমন তাপমাত্রা ও ভোল্টেজের ওঠা-নামা, যন্ত্রের কম্পন ইত্যাদি কারণে হতে পারে। এ ধরনের ত্রুটি কখনোই পুরোপুরি দূর করা যায় না।
ত্রুটির গণনা (Calculation of errors):
উপরের টেবিলটি লক্ষ্য করো। ধরো, তুমি একটি দন্ডের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করবে। তুমি সাধারণ স্কেল দিয়ে 4 বার দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে দেখলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানগুলি এলো যথাক্রমে 2.5 m, 2.4 m, 2.7 m ও 2.4 m। লক্ষ্য করো, এখানে 4 টি ক্ষেত্রে 4 টি আলাদা আলাদা মান এসেছে, তাহলে তোমার পরিমাপে অবশ্যই কিছু ত্রুটি আছে। অর্থাৎ তোমার মাপা মান, প্রকৃত মান থেকে কিছু কম বা বেশি। তাই তো? কিন্তু এর প্রকৃত মান যে কী, সেটা কিন্তু কেউই জানে না। আগেও বললাম, কোনো ভৌত রাশির প্রকৃত মান কী সেটা বের করা অসম্ভব। তাহলে এর প্রকৃত মান জানবো কী করে! এর একটি উপায় হলো , তুমি পরিমাপ করে যে মানগুলি পেয়েছো সেগুলোর গড় (mean) বের করবে। যে গড়মানটি পাবো, সেটাকে আমরা প্রকৃত মান হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। পরিমাপের সংখ্যা যত বেশি হবে, প্রকৃত মানও তত সূক্ষ্ম হবে। তাহলে এর গড় মান হলো
আমরা কোনো ভৌত রাশির চূড়ান্ত মান যখন লিখি, তখন শুধু প্রকৃত মান (true value) লিখিনা। প্রকৃত মানে কতটা ত্রুটি থাকতে পারে তা উল্লেখ করতে হয়। তাই এক্ষেত্রে দন্ডটির দৈর্ঘ্যের চূড়ান্ত মান 2.5±0.1 m। অর্থাৎ, আমরা যদি পরিমাপ করি, তবে তার মান 2.5+0.1=2.6 ও 2.5-0.1=2.4 -এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
ভগ্নাংশ ত্রুটি বা আপেক্ষিক ত্রুটি (fractional error or relative error):
"আপেক্ষিক" কথাটি শুনেই বুঝতে পারছো, কোনো কিছুর সাপেক্ষে আর একটা কিছু বোঝাচ্ছে। চরম ত্রুটি ও প্রকৃত মানের অনুপাতকে ভগ্নাংশ ত্রুটি বা আপেক্ষিক ত্রুটি বলে।
এক্ষেত্রে আপেক্ষিক ত্রুটি 0.12.5=0.04
লক্ষ্যনীয়, দুটি সমজাতীয় রাশির অনুপাত তাই এর কোনো একক নেই।
শতকরা ত্রুটি (Percentage error):
ভগ্নাংশ ত্রুটিকে 100 দিয়ে গুণ করে শতকরা ত্রুটি বের করা হয়। এক্ষেত্রে শতকরা ত্রুটি 0.04×100=4%।
এখন সাধারণভাবে যদি দেখি, ধরো তুমি কোনো ভৌত রাশির n বার পরিমাপ করলে, তাতে বিভিন্ন মান পেলে যথাক্রমে x1, x2, x3,......xn।
তাহলে প্রকৃত মান (true value),
ˉx = (x1+x2+x3+....+xn)n
=1nn∑i=1xi
চরম ত্রুটি হবে যথাক্রমে
|∆x1|=|x1-ˉx|,
|∆x2|=|x2-ˉx|
......
|∆xn|=|xn-ˉx|
'| |' এই চিহ্নটিকে বলা হয় Modulus operator। এর কাজ হলো এর ভেতরে যে মানই থাক না কেন, সবসময় তার মান ধনাত্মক হবে। আর খুব ক্ষুদ্র মানের পার্থক্য বোঝাতে আমরা '∆(delta)' চিহ্নটি ব্যবহার করেছি। অর্থাৎ ∆x1 মানে হলো x1-এর পরিমাপে যে ত্রুটি (খুব ক্ষুদ্র মানের)।
গড় চরম ত্রুটি হবে, e
=(|∆x1|+|∆x2|+....+|∆xn|)n
=1nn∑i=1|∆xi|
চূড়ান্ত মান (final result) লেখা যায়, x=ˉx±e
ভগ্নাংশ বা আপেক্ষিক ত্রুটি =eˉx
শতকরা ত্রুটি =eˉx×100%
ত্রুটির বিস্তার বা সমবায় (Propagation or combination of errors):
যখন কোন পরীক্ষালব্ধ ফলাফল একাধিক পরিমাপের ওপর নির্ভর করে তখন ফলাফল নির্ণয়ে মোট ত্রুটি প্রতিটি পরিমাপের ত্রুটির ওপর নির্ভর তো করেই তার সাথে রাশিগুলির মধ্যে যেসব গাণিতিক প্রক্রিয়ায় (যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ ইত্যাদি) ফলাফল নির্ণয় করা হয়, তার ওপরেও নির্ভর করে। যেমন পদার্থের ভরকে আয়তন দিয়ে ভাগ করলে ঘনত্ব পাওয়া যায়। যদি ভর বা আয়তন পরিমাপে ত্রুটি থাকে তবে ঘনত্বের পরিমাপেও অবশ্যই ত্রুটি থাকবে।
ধরো, দুটি ভৌত রাশি A ও B এর পরিমিত মানগুলি যথাক্রমে A±∆A এবং B±∆B। যেখানে ∆A ও ∆B ওদের চরম ত্রুটি। খেয়াল রাখবে, এখানে A ও B এর প্রকৃত মান (true value), ˉA বা ˉB লিখিনি। সুবিধার্থে A ও B কেই প্রকৃত মানের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছি।
1) দুটি রাশির যোগের ক্ষেত্রে ত্রুটি:
এখন যদি Z=A+B হয়, আমরা Z এর ত্রুটি ∆Z বের করবো।
Z নির্ণয়ের সর্বাধিক (maximum) ত্রুটিপূর্ণ মান হবে,
Z+∆Z
= (A+∆A)+(B+∆B)
= A+B+(∆A+∆B)
বা, ∆Z=∆A+∆B
(যেহুতু Z = A+B, তাই দুদিকে cancel করা পাই)
এবং সর্বনিম্ন (minimum) ত্রুটিপূর্ণ মান হবে,
Z-∆Z
= (A-∆A)+(B-∆B)
= A+B-(∆A+∆B)
বা, ∆Z=∆A+∆B
সুতরাং, যখন দুটি রাশির যোগ করা হয় তখন চূড়ান্ত ফলাফলের চরম ত্রুটির মান হবে প্রতিটি রাশির চরম ত্রুটির যোগফল।
2) দুটি রাশির বিয়োগের ক্ষেত্রে ত্রুটি:
ধরো, Z=A-B
Z নির্ণয়ের সর্বাধিক ত্রুটিপূর্ণ মান হবে,
Z+∆Z
= (A+∆A)-(B-∆B)
= A-B+(∆A+∆B)
বা, ∆Z=∆A+∆B
লক্ষ্য করে দেখো, A এর সর্বাধিক ত্রুটিপূর্ণ মান থেকে B এর সর্বনিম্ন ত্রুটিপূর্ণ মান বিয়োগ করলে Z এর সর্বাধিক ত্রুটিপূর্ণ মান পাওয়া যাবে।
এবং সর্বনিম্ন ত্রুটিপূর্ণ মান,
Z-∆Z
= (A-∆A)-(B+∆B)
= A-B-(∆A+∆B)
বা, ∆Z=∆A+∆B
লক্ষ্য করে দেখো, A এর সর্বনিম্ন ত্রুটিপূর্ণ মান থেকে B এর সর্বাধিক ত্রুটিপূর্ণ মান বিয়োগ করলে Z এর সর্বনিম্ন ত্রুটিপূর্ণ মান পাওয়া যাবে।
সুতরাং, যখন দুটি রাশির বিয়োগ করা হয় তখন চূড়ান্ত ফলাফলের চরম ত্রুটির মান হবে প্রতিটি রাশির চরম ত্রুটির যোগফল।
উপরের আলোচনা দুটি থেকে বোঝা গেলো যোগ বা বিয়োগ উভয়ক্ষেত্রেই আমরা চূড়ান্ত ফলাফলের চরম ত্রুটি বের করতে প্রতিটি রাশির চরম ত্রুটিগুলি যোগ করবো।
3) দুটি রাশির গুণের ক্ষেত্রে ত্রুটি:
ধরো, Z=AB
Z নির্ণয়ের সর্বাধিক ত্রুটিপূর্ণ মান হবে,
Z+∆Z
= (A+∆A)(B+∆B)
= AB+A∆B+B∆A+∆A∆B
বা, ∆Z=A∆B+B∆A
(যেহেতু Z=AB তাই দুদিকে cancel করা যাবে এবং ∆A∆B খুব ক্ষুদ্র, তাই neglect করতে পারি)
বা, ∆ZZ=∆BB+∆AA (দুদিকে Z=AB দিয়ে ভাগ করে পাই)
এবং সর্বনিম্ন ত্রুটিপূর্ণ মান,
Z-∆Z
= (A-∆A)(B-∆B)
= AB-A∆B-B∆A+∆A∆B
বা, ∆Z=A∆B+B∆A
বা, ∆ZZ=∆BB+∆AA
সুতরাং, যখন দুটি রাশির গুণ করা হয় তখন ফলাফলে আপেক্ষিক ত্রুটির মান হবে প্রতিটি রাশির আপেক্ষিক ত্রুটির যোগফল।
4) দুটি রাশির ভাগের ক্ষেত্রে ত্রুটি:
ধরো, Z=AB। আরও ধরো, 1B=C। সুতরাং, Z = AC।
এখন যদি C এর আপেক্ষিক ত্রুটি, B এর আপেক্ষিক ত্রুটির সমান দেখাতে পারি, তাহলেই আগের আলোচনা থেকে বলতে পারবো, এক্ষেত্রেও আপেক্ষিক ত্রুটির পরিমাণ হবে প্রতিটি রাশির অর্থাৎ A ও B -এর আপেক্ষিক ত্রুটির যোগফল। বুঝলে না? দেখো Z =AC এবং A -এর আপেক্ষিক ত্রুটি ∆AA ও C -এর আপেক্ষিক ত্রুটি ∆CC হলে, আগের আলোচনা থেকে আমরা Z -এর আপেক্ষিক ত্রুটি ∆ZZ=∆AA+∆CC লিখতে পারি। কিন্তু এখন যদি দেখাতে পারি, ∆CC=∆BB তাহলে আমরা বলতে পারি Z এর আপেক্ষিক ত্রুটি হবে A ও B এর আপেক্ষিক ত্রুটির যোগফল।
C নির্ণয়ের সর্বাধিক ত্রুটিপূর্ণ মান হবে,
C+∆C
= 1(B-∆B)
= (B+∆B)B2-(∆B)2
= 1B+∆BB2
বা, ∆C=∆BB2
বা, ∆CC = ∆BB2×C = ∆BB (যেহেতু C=1B)
লক্ষ্য করে দেখো C এর ত্রুটিপূর্ণ মান সর্বাধিক হবে যখন B এর ত্রুটিপূর্ণ মান সর্বনিম্ন।
এবং সর্বনিম্ন ত্রুটিপূর্ণ মান,
C-∆C
= 1(B+∆B)
= (B-∆B)B2-(∆B)2
= 1B- ∆BB2
বা, ∆C=∆BB2
বা, ∆CC = ∆BB2×C = ∆BB
সুতরাং, যখন দুটি রাশির ভাগ করা হয় তখন ফলাফলে আপেক্ষিক ত্রুটির মান হবে প্রতিটি রাশির আপেক্ষিক ত্রুটির যোগফল।
উপরের আলোচনা দুটি থেকে বোঝা গেলো গুন বা ভাগ উভয়ক্ষেত্রেই আমরা চূড়ান্ত ফলাফলের আপেক্ষিক ত্রুটি বের করতে প্রতিটি রাশির আপেক্ষিক ত্রুটিগুলি যোগ করবো।
কোনো ঘাত যুক্ত রাশির ক্ষেত্রে:
ধরো, Z=ApBqCr
এখানে A এর ঘাত p অর্থাৎ A×A×A×......p বার।
তোমরা আগের আলোচনা থেকে জানো, কোনো রাশি যদি এরকম গুণফলের আকারে থাকে সেক্ষেত্রে মোট আপেক্ষিক ত্রুটি, প্রতিটি রাশির আপেক্ষিক ত্রুটির যোগফল হয়।
A তে আপেক্ষিক ত্রুটির পরিমাণ যদি ∆AA হয়, তবে Ap তে আপেক্ষিক ত্রুটি হবে, ∆AA+∆AA+∆AA+......p বার =p∆AA।
একইভাবে, Bq এ আপেক্ষিক ত্রুটি হবে, q∆BB।
কিন্তু C এর ঘাত -r। আগের আলোচনাতে দেখলাম, ভাগের ক্ষেত্রেও মোট আপেক্ষিক ত্রুটি প্রতিটি রাশির আপেক্ষিক ত্রুটির যোগফল হয়।
তাহলে Z এ আপেক্ষিক ত্রুটি হবে,
∆ZZ=p∆AA+q∆BB+r∆CC
তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা (Significant figures):
আগের আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম, একেবারে ত্রুটিমুক্ত পরিমাপ সম্ভব নয়। পরিমাপে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকেই যায়। তাই, পরিমাপের ফলাফলকে আমরা এমনভাবে প্রকাশ করি, যা বেশি সূক্ষ্মতা সূচিত করে।
কোন পাঠ বা ভৌত রাশির মান যে অঙ্কগুলো (digits) দিয়ে গঠিত হয় সেগুলির শেষ অঙ্কটি বাদ দিয়ে বাকি অঙ্কগুলি যদি নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় তবে, ওই পাঠটি বা মানটি যত সংখ্যক অঙ্ক দিয়ে গঠিত সেটিকে তার তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা বলা হয়।
যেমন ধরো, তুমি স্কেল (যার ক্ষুদ্রতম ঘরের মান 1 mm) দিয়ে একটি বস্তুর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে দেখলে তার মান 15.3 cm এর বেশি কিন্তু 15.4 cm এর কম। এখন তুমি চোখের আন্দাজে এর মান লিখবে 15.3 cm বা 15.4 cm। এই মানের শেষ অঙ্কটি মোটেও নিশ্চিত নয়। এক্ষেত্রে পাঠটির তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 3 (2 টি নিশ্চিত অঙ্ক এবং 1 টি অনিশ্চিত অঙ্ক)।
কোন পাঠ বা ভৌত রাশির মানের তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা গণনা করার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনে রাখা প্রয়োজন:
1. সমস্ত অশূন্য অঙ্কগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন 1537, 23.689 ইত্যাদি।
2. কোনো সংখ্যার তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা বের করার সময়, সংখ্যাটির সবচেয়ে বামদিকের প্রথম অশূন্য অঙ্ক থেকে গণনা শুরু করবো। যেমন 27.3679, এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 6 টি।
3. দশমিক বিন্দু যেখানেই থাক না কেন, দুটি অশূন্য অঙ্কের মধ্যবর্তী সমস্ত শূন্যগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন 206.320054, এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 9 টি।
4. 1 এর থেকে ছোট সংখ্যাতে, দশমিক বিন্দু ও তার ডানদিকে থাকা প্রথম অশূন্য অঙ্কের মাঝে থাকা শূন্যগুলি তাৎপর্যপূর্ণ নয়। যেমন 0.000367, এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 3 টি।
5. দশমিক বিন্দুর ডানদিকে থাকা শূন্যগুলি তাৎপর্যপূর্ণ হয়। যেমন 236.0, এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 4 টি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 236 ও 236.0 এর মধ্যে পার্থক্যটি হলো, 236 এ তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 3 টি, যার মধ্যে দুটি সংখ্যা নিশ্চিত এবং শেষ সংখ্যাটি অর্থাৎ 6 অনিশ্চিত। আর 236.0 তে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 4 টি, যার মধ্যে তিনটি সংখ্যা নিশ্চিত এবং শেষ সংখ্যাটি অর্থাৎ 0 অনিশ্চিত।
6. দশমিক বিন্দু ছাড়া কোনো সংখ্যার শেষের শূন্যগুলি তাৎপর্যপূর্ণ হয় না। যেমন 23500, এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 3 টি।
7. শেষের দিকের শূন্যগুলো নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। ধরা যাক একটি দৈর্ঘ্যকে 5.300 m দ্বারা প্রকাশ করা হলো। এখানের শূন্যগুলি পরিমাপের সূক্ষ্মতা (যা পরিমাপক যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল) অর্থে ব্যবহৃত এবং তাই এরা তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা এখন এককগুলো যদি পরিবর্তন করে লিখি, তাহলে 5.300 m = 5300 mm। যেহেতু আগের নিয়মে দেখলাম দশমিক ছাড়া কোনো সংখ্যায় শেষের দিকের শূন্যগুলো তাৎপর্যপূর্ণ নয় তাই আমরা ভুল তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 2 বলতে পারি। কিন্তু শুধুমাত্র এককের পরিবর্তনে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যার পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ এখানে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 4 টিই থাকবে।
8. তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যার গণনায় এধরনের ভ্রান্তি দূর করার জন্যে আমরা মানগুলিকে 10 -এর ঘাতে অর্থাৎ a×10b আকারে লিখবো। তাহলে আগের মানগুলি যদি 5.300 m=5.300×103 mm। তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা নির্ণয়ে 10 এর ঘাত অপ্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে প্রতিটি মানে 4 টি তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা।
9. কোনো সূত্রে ব্যবহৃত গুন বা ভাগের গুণনীয়কগুলি (factors) যা পরিমাপ করা নয়, তাদের অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা থাকে। যেমন বৃত্তের পরিধি নির্ণয়ে "2πr" এর 2 সংখ্যাটি প্রয়োজনমত 2.0, 2.00 বা 2.0000 ইত্যাদি লেখা যেতে পারে।
তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসহ পাটিগণিতের প্রক্রিয়া:
1. গুন বা ভাগের নিয়ম:
ধরো, কোনো বস্তুর পরিমিত ভর 4.237 g (তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 4) এবং পরিমিত আয়তন 2.51 cm3 (তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা 3)। এখন সাধারণ গণিতের নিয়মে এর ঘনত্ব বের করলে হয়, 4.237/2.51 = 1.6880478087649 g/cm3, যা 13 দশমিক স্থান পর্যন্ত। কিন্তু আমরা বাস্তবে যেভাবে ঘনত্ব পরিমাপ করি, তাতে এতটা সূক্ষ্ম পরিমাপ অসম্ভব। তাই তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসহ গুন বা ভাগের জন্যে নীচের নিয়ম অনুসরণ করা হয় যা পরিমিত মানের যথার্থতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
গুন বা ভাগের সময় যে দুটি সংখ্যা নিয়ে গুন বা ভাগ করা হয়, তাদের মধ্যে কোনটির তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা কম সেটি দেখা হয়। এই তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা এবং গুনফল বা ভাগফলের তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা সমান রাখতে হয়।
সুতরাং, উপরের উদাহরণটিতে ভর ও আয়তনের পরিমিত মানে আয়তনের তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা কম (3 টি)। তাই আমরা ঘনত্বের মান এমনভাবে লিখবো যাতে সেটিতে 3 টি তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা হয়। অর্থাৎ আমরা লিখবো 1.69 g/cm3 (তোমরা আসন্নমানের বিষয়টি হয়তো জানো। আসন্নমানের জন্যেই আমরা 8 কে 9 লিখেছি। এ বিষয়ে একটু পরেই বিস্তৃত আলোচনা করবো)।
যোগ বা বিয়োগের নিয়ম:
যোগ বা বিয়োগের সময় যে দুটি সংখ্যা নিয়ে যোগ বা বিয়োগ করা হয়, তাদের মধ্যে কোনটির দশমিক বিন্দুর ডান দিকে অবস্থিত অঙ্কসংখ্যা কম সেটি দেখা হয়। এই অঙ্কসংখ্যা এবং যোগফল বা বিয়োগফলের দশমিক বিন্দুর ডানদিকে অবস্থিত অঙ্কসংখ্যা সমান রাখতে হয়। এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অঙ্কসংখ্যা গুরুত্বহীন।
যেমন ধরো, তিনটি বস্তুর ভর 450.52 g (দশমিক বিন্দুর ডানদিকে অঙ্কসংখ্যা 2), 225.2 g (দশমিক বিন্দুর ডানদিকে অঙ্কসংখ্যা 1) এবং 0.384 g (দশমিক বিন্দুর ডানদিকে অঙ্কসংখ্যা 3)।
যোগ করলে পাবো 450.52+225.2+0.384 = 676.104 g। কিন্তু এক্ষেত্রে যোগফলের দশমিক বিন্দুর ডানদিকে অবস্থিত অঙ্কসংখ্যা হওয়া উচিত 1 (225.2 g এর জন্যে)।
সুতরাং, যোগফল হবে, 676.1 g।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমরা উক্ত নিয়মগুলো অনুসরণ করে ফলাফলগুলো আসন্ন মানে প্রকাশ করবো।
আসন্ন মান (rounding off) নির্ণয়ের নিয়ম:
যে সংখ্যার মধ্যে একের বেশি অনিশ্চিত অঙ্ক থাকে তাদের গণনার ফল পূর্ণসংখ্যার গুণিতকে পরিণত করে নেওয়া উচিত অর্থাৎ পরীক্ষালব্ধ মান থেকে চূড়ান্ত ফল (final result) গণনা করার সময় সেই ফলাফলে এমন কিছু অঙ্কসংখ্যা পড়ে থাকে যেগুলো আমরা প্রয়োজনে অগ্রাহ্য করতে পারি। এই অঙ্ক সংখ্যাগুলি বাদ দিয়ে আসন্নমান নির্ণয়ের নিয়মগুলি নীচে লেখা হলো।
1. যে অঙ্কটি বাদ দেওয়া হচ্ছে তার মান 5 এর কম হলে আগের অঙ্কটি অপরিবর্তিত থাকবে। যেমন, 5.234 এর দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত আসন্নমান হলো 5.23 (কারণ 4<5)।
2. যে অঙ্কটি বাদ দেওয়া হচ্ছে তার মান 5 এর বেশি হলে আগের অঙ্কটির মান 1 বাড়াতে হবে। যেমন, 8.319 এর দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত আসন্নমান হলো 8.32 (কারণ 9>5)।
3. যে অঙ্কটি বাদ দেওয়া হচ্ছে তার মান ঠিক 5 হলে এবং এর পরে কোনো অশূন্য (non zero) অঙ্ক থাকলে 5 এর আগের অঙ্কটির মান 1 বাড়াতে হবে। যেমন, 35.4153 এর দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত আসন্নমান হলো 35.42 (কারণ ঠিক 5 ও তার পরের অঙ্ক অশূন্য অর্থাৎ 3)।
4. যে অঙ্কটি বাদ দেওয়া হচ্ছে তার মান ঠিক 5 হলে বা 5 এর পরে শূন্য থাকলে এবং 5 এর আগের অঙ্কটি জোড় সংখ্যা হলে তার মান অপরিবর্তিত থাকবে। যেমন, 35.425 বা 35.4250 এর দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত আসন্নমান হলো 35.42 (কারণ ঠিক 5 বা তার পরের অঙ্ক শূন্য এবং 5 এর আগের অঙ্কটি হলো 2 অর্থাৎ জোড় সংখ্যা)।
5. যে অঙ্কটি বাদ দেওয়া হচ্ছে তার মান ঠিক 5 হলে বা 5 এর পরে শূন্য থাকলে এবং 5 এর আগের অঙ্কটি বিজোড় সংখ্যা হলে তার মান 1 বাড়াতে হবে। যেমন, 35.675 বা 35.6750 এর দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত আসন্নমান হলো 35.68 (কারণ ঠিক 5 বা তার পরের অঙ্ক শূন্য এবং 5 এর আগের অঙ্কটি হলো 7 অর্থাৎ বিজোড় সংখ্যা)।
পরিমাপ যন্ত্রের সঠিকতা (accuracy) ও যথার্থতা বা সুসংহতি (precision):
কোন যন্ত্রের সাহায্যে পরিমাপ করার আগে যন্ত্রের সঠিকতা এবং যথার্থতা কী তার ধারণা থাকা উচিত।সঠিকতা (accuracy): কোন যন্ত্রের সঠিকতা বলতে বোঝায়, সেই যন্ত্রের সাহায্যে কোন ভৌত রাশি মাপলে তার যা মান পাওয়া যায় সেটি আসল মানের ঠিক কতটা কাছাকাছি।
যেমন ধরো, একটি তুলাদন্ডের সাহায্যে তুমি 100 গ্রামের একটি বাটখারার ভর পরিমাপ করে দেখলে, তুলাদন্ডটি সেটির ভর 95 গ্রাম দেখাচ্ছে। সুতরাং তুলাদন্ডটি সঠিক নয়। পরিমাপ করা মান 100 গ্রামের যত কাছাকাছি হবে, তুলাদন্ডটি তত সঠিক বা তুলাদন্ডটির সঠিকতা তত ভালো।
যথার্থতা (precision):
কোনো যন্ত্রের যথার্থতা বলতে বোঝায়, ওই যন্ত্রের সাহায্যে কোন ভৌত রাশি কয়েকবার পরিমাপ করে যে মানগুলি পাওয়া যায় সেগুলি পরস্পরের কতটা কাছাকাছি।
যেমন ধরো, একটি তুলাদন্ডের সাহায্যে তুমি 100 গ্রামের একটি বাটখারার ভর 5 বার পরিমাপ করে দেখলে তুলাদন্ডটি সেটির ভর 90 g, 96 g, 92 g, 93 g ও 97 g দেখাচ্ছে। সুতরাং, তুলাদন্ডটি যথার্থ বা সুসংহত নয়। পরিমাপ করা মানগুলো যত পরস্পরের কাছাকাছি হবে, তুলাদন্ডটির যথার্থতা তত ভালো।
একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করো। ধরো, তোমাকে দেওয়ালে একটা গোল দাগ কেটে বলা হলো, সেখানে বল ছুঁড়ে মারতে। তুমি যদি ঠিক জায়গায় মারো তবে সেটা সঠিকতার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু তুমি যদি ওখানে না মেরে তার পাশে বারবার মারো, সেক্ষেত্রে তোমার যথার্থতা থাকলেও সঠিকতা বা accuracy নেই।
একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, কেবলমাত্র একটি পরিমাপের সাহায্যেই কোনো যন্ত্রের সঠিকতা নির্ণয় করা যায়। কিন্তু কোন যন্ত্রের যথার্থতা নির্ণয় করার জন্য বেশ কয়েকটি পরিমাপের প্রয়োজন হয়।
Post a Comment